বাংলাদেশের সুফী সাধনা ও মরমী সাহিত্য জগতে রকীব শাহ্ (র:) একটি উজ্জ্বল নাম। দরবেশ শিরোমণি হযরত শাহাজালাল (র:) ও ৩৬০ আউলিয়ার পূণ্য স্মৃতিধন্য সিলেট শরীফে সুফীবাদের প্রেরণায় উজ্জ্বীবিত মরমী সাহিত্যে সুফীবাদী এই মরমী ধারার বিকাশে হাসন রাজা, শীতালং শাহ, ইব্রাহিম তশনা, আরকুম শাহ প্রমুখের সাথে রকীব শাহেরও রয়েছে গৌরবৌজ্জ্বল অবদান।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলানিকেতন, যুগ যুগ ধরে পবিত্র ভূমির মর্যাদায় অভিষিক্ত বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট শরীফের কাজীটুলায় ১৩০৮ সনের ১৭ ফাল্গুন সূফী সাধক ও মরমী কবি রকীব শাহ (কাজী আবদুর রকীব) জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা কাজী মোঃ ইব্রাহীম ও মাতা জমির রৌশন দীর্ঘদিন সন্তান না পাওয়ায় অত্যন্ত ব্যাকুল ছিলেন। এক সুফী সাধকের নির্দেশে জমির রৌশনকে খাঁচায় বন্দী বাঘের উপর দাঁড় করিয়ে গাভীর দুধ দিয়ে গোসল করানো হয়। এর পর আল্লাহর অশেষ রহমতে পিতা-মাতার বহু আকাংখিত সন্তান রকীব শাহ জন্ম গ্রহন করেন।

শৈশব ও কৈশোরেই রকীব শাহের ব্যতিক্রমী স্বত্ত্বার স্ফুরন ঘটতে থাকে। জগত ও জীবন সর্ম্পকে অনন্ত কৌতুহল তাকে চঞ্চল করে তোলে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপণ না করেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বেরিয়ে পড়েন অজানা উদ্দেশ্যে। একটানা এগার বছর ঘুরে বেড়ান দেশ-দেশান্তরে। ভ্রমণ করেন যুক্তরাজ্য, হল্যান্ড, জার্মানী, রাশিয়া, নরওয়ে, ইরান, আফগানিস্তান, চীন, জাপান, কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, বার্মা, শ্রীলংকা, ভারত প্রভৃতি দেশ। এগার বছর পর দেশে ফিরে সংসারের হাল ধরতে চাকুরী নিতে হয় তাকে।

চাকুরীতে থাকাকালে এক সুফী সাধকের সান্নিধ্য বদলে দেয় রকীব শাহ্রে চিন্তাচেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গী। সুফীবাদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে তিনি সিলেটের অন্যতম সাধক ও কবি আরকুম শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ছয় মাস পর আরকুম শাহ্ ইন্তেকাল করেন। তারপর রকীব শাহ্ আরকুম শাহের মুর্শিদ লতীফ শাহ্ (র:) এর শিষ্যত্ত্ব গ্রহন করেন। লতিফ শাহ্ (র:) এর নির্দেশনায় তিনি সাধনায় নিমগ্ন হন। এসময় তিনি প্রায় প্রতিদিনই হযরত শাহজালাল (রঃ) এর দরগা শরীফে গিয়ে ইবাদত বন্দেগী করতেন। ফানাফিল্লাহ অবস্থায় রকীব শাহ্ (র:) খাদিম নগরে অবস্থিত হযরত শাহ্ পরান (র:) এর মাজারে অনেক নির্জন রাত ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। নিস্তদ্ধ রাতে নির্জন মাজারে একদিকে বাঘ এসে ভক্তি জানাত আর  অন্যদিকে রকীব শাহ্ মশগুল হয়ে থাকতেন ধ্যানে।

সাধনায় পূর্ণতা লাভের পর রকীব শাহ (রা) সুফী সাধক হিসেবে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেন। তার শিষ্য ও ভক্ত সংখ্যা বাড়তে থাকে। তিনি তার ভক্ত ও শিষ্যদের শিক্ষার দিকে নজর দিতেন বেশী। তার শিক্ষা ছিল মানুষকে ভালবাসো, হিংসা-বিদ্ধেষ ভুলে যাও, রিপুকে নিয়ন্ত্রণ কর ইত্যাদি।

রকীব শাহ্ ছিলেন স্বভাব কবি। কৈশোরেই তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার দিকে আকৃষ্ট হন। বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম সুতিকাগার মুসলিম সাহিত্য সংসদ-সিলেট এ তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন, সাহিত্য আসরে যোগদান করতেন। সংসদের সাহিত্য আসর শুরু হত তার গান দিয়ে। এ সময় আল-ইসলাহ্ ও অন্যান্য পত্রিকায় তার লেখা কবিতা, গান, প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত হত। রকীব শাহ্ রচনা করেন প্রায় এক হাজার মরমী  গান, অসংখ্য কবিতা ও আধ্যাত্মিক প্রবন্ধ। লালন-হাসন-শীতালং-আরকুম শাহ্ প্রমুখের মত তার মরমী গানও চেতনা ও ভাবের দ্যোতনায় অভিন্ন। রকীব শাহের সংগীতের ভাব, ভাষা ও সুর সহজেই মর্মস্পর্শ করে। জগত ও জীবন সম্পর্কে, মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক অদৃশ্য স্বত্ত্বা সম্পর্কে মানব চিত্তের ব্যাকুলতা তার রচনায় ফুটে উঠেছে সহজ সরল ভাষায়। ‘মানুষ তারে চিনরে-নয় দরজার ঘর বানাইয়া বিরাজ করে কে’ ? তারই সন্ধান করেছেন রকীব শাহ্ জীবনব্যাপী সাধনায় ও রচনায়।

রকীব শাহ্রে রচনা শুধুমাত্র মরমী চেতনালোকে দীপ্ত নয়-প্রেম, দ্রোহ ও প্রকৃতির নিবারণ প্রকাশ তার রচনাকে করেছে সমৃদ্ধ ও মাধুর্যমন্ডিত। ভক্ত-শিষ্যের পরিমন্ডল পেরিয়ে তার রচনা সমাদৃত হয়েছে গুণীজনদের কাছে। রকীব শাহ্রে মরমী সঙ্গীতের প্রথম গ্রন্থ ‘বোস্তান-উল-মারিফত’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে (১৩৫১ বাংলা)। জীবিত থাকা কালে তার আর দু’টি মরমী সঙ্গীত গ্রন্থ ‘মারিফতের কিস্তি’ (১৯৪৬ ইং, ১৩৫২ বাংলা) ও হকিকত-এ-গুলজার’ (১৯৫১ইং, ১৩৫৮ বাংলা) প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত রকীব শাহ্রে ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং অপ্রকাশিত কিছু পান্ডুলিপি মুদ্রণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতিমধ্যে তার রচনার অনেক মূল্যায়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেক গুণী সাহিত্যিক গবেষক রকীব শাহ্ (র:) এর উপর জীবনী ও গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন।  রকীব শাহ্ সম্পর্কে পাঠক মহলে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। রেডিও বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ টেলিভিশন হতে বিভিন্ন খ্যাতিমান শিল্পীর কন্ঠে রকীব শাহ্রে গান পরিবেশিত হয়েছে। কবি আসাদ চৌধুরী রকীব শাহকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেন-‘‘রকীব শাহ মানব প্রেমিক ও আধ্যাত্ম সাধক। তার রচনা সহজ এবং অবশ্যই গীতিময়। ধার্মিকের প্রসন্নতা এবং ¯িœগ্ধ পবিত্রতা তার রচনাকে দিয়েছে মাধুর্য্য ও লাবণ্য। তার সৃষ্টি আমাদের অমূল্য সম্পদ’। রকীব শাহ্ বাংলা ছাড়াও ইংরেজী, আরবী, উর্দু, ফারসী প্রভৃতি ভাষায় দক্ষ ছিলেন।

মরমী সাহিত্য ধারার উজ্জ্বল নক্ষত্র সুফী সাধক রকীব শাহ্ জীবনের অধিকাংশ সময় আধ্যাত্মিক সাধনা, ইবাদত-বন্দেগী ও সাহিত্য চর্চায় অতিবাহিত করেছেন। সমস্ত জীবন পরম সত্যের সাধনায় নিয়োজিত থেকে অগনিত ভক্ত শিষ্য ও গুণাগ্রাহী রেখে ৬৬ বছর বয়সে ১৩৭৪ সনের ২৮শে বৈশাখ শুক্রবার হযরত রকীব শাহ্ (র:) জান্নাতবাসী হন। এক বছর আগে তিনি নিজে নির্ধারণ করে দেয়া স্থানে তাকে সমাহিত করা হয় এবং এরপরই ভক্তদের উদ্যোগে ১৯৬৭ ইংরেজীতে এ স্থানে তার মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়।